প্রথম পর্ব:

লেখাটা কোন পর্যায়ে ফেলবো বুঝতে পারছি না, নিছক ভ্রমণ কাহিনী, মিথোলজি নাকি একটা ছোট্ট গ্রামের ইতিকথা ও তার বর্তমান রূপ। তবে লেখার শুরুতেই আমাদের পূজনীয়  পিতৃপুরুষদের শতকোটি প্রণাম। তাঁরা বহুগুণে আমাদের থেকে বুদ্ধিমান ও মানসিক উৎকর্ষতার অধিকারী ছিলেন। তাই তাঁরা ধর্মীয় স্থানগুলি এমন ভাবে নির্বাচন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন যার সাথে প্রকৃতির এক নিবিড় যোগ রয়েছে। তদুপরি কিছু স্থান আছে যেখানে পৌঁছাতে পারা বেশ কষ্টসাধ্য। আসলে তাঁরা চেয়েছিলেন প্রকৃতিযোগের সাথে সাথে কৃচ্ছসাধন আর কষ্টসাধন। অবশ্যই এপ্রসঙ্গে তৎকালীন ব্রাহ্মণকূলের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন রাজা ও রাজন্যবর্গের মাথায় হাত বুলিয়ে এই ব্রাহ্মণকূল যথেচ্ছভাবে নিজেদের পাওয়ার এক্সারসাইজ করতেন সত্যি, কিন্তু এই দুর্গম ও দর্শনীয় স্থানে মন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা প্রশংসনীয়।

মানুষের মন যত কুটিল, জটিল বা সর্পিলই হোক না কেন তা স্প্লিটিং মাইন্ডেড বা দ্বৈতসত্ত্বাযুক্ত। একটি ঘোর সংসারী সত্ত্বা; এর দ্বারাই মানুষের জীবনের বেশিরভাগ সময়টা পরিচালিত হয়। এতে মানুষ শুধু সংসারের চাওয়া-পাওয়া, লাভ-ক্ষতির হিসাবই করে শুধু। আরেকটি দুর্বল সত্ত্বাও আছে, যে কাছাখোলা বিমুক্তানন্দ, একেবারে যেন শিকলছেঁড়া গোবিন্দ। পাহাড়, জঙ্গল, মরুভূমি, নদী-সমুদ্রের সংস্পর্শে , এককথায় প্রকৃতির স্পর্শে সেই সত্ত্বা ওঠে জেগে।

আসলে আমরা অমৃতের পুত্র, আনন্দের উপাসক। তাই তো সংসারের জটিলতা থেকে আমাদের মন পালিয়ে যেতে চায়, পেতে চায় ছুটি। ভ্রমণ আমাদের মনের সেই উচাটন ভাব ও অশান্তি দূর করে মানসিক পুষ্টি ও তুষ্টি ঘটায়। লক্ষ্য করে দেখবেন একঘেয়ে সাংসারিক আবর্ত থেকে বেরিয়ে কয়েকদিনের জন্য ঘুরে এলে নিজের ঘরটাকেও যেন নতুন করে ভালো লাগবে। তবে এটা কিন্তু হোমসিকনেস নয়।

ফ্ল্যাশব্যাক: ৩৫ বছর আগে। তখন আমার বেশ সেন্স হয়েছে। সকাল বেলার মিষ্টি সূর্যের স্পর্শ বুঝি। চারদিকের সবুজ গাছপালা, রং-বেরঙের- ফুল- ফল এর সান্নিধ্য আমায় তৃপ্তি দেয়। পড়াশুনার থেকেও বেশি আকর্ষণ করে গুলি খেলা, পিট্টু খেলা বা ঘুড়ি ওড়ানো। আর সবচেয়ে বেশি টানে নীল আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া নীল পাহাড়। তার গায়ে অগণিত দেশলাই বাক্সের মতো ছোট্ট ছোট্ট ঘর। রাত্রি বেলা, পরিষ্কার আকাশে ওই পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতো জ্বলে অসংখ্য আলো। শুনেছিলাম ওটা নাকি কার্শিয়াং আর তিনধারিয়ার ঘর বাড়ির আলো। কখনো-সখনো উঁকি মারতো বরফ-ঢাকা সাদা সাদা শৃঙ্গ-রাজি। ওটাই নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা। বেশ অবাকই লাগতো। তখন থেকেই মনে হতো ছুটে যাই ওই নীল পাহাড়ের বুকে। পরিবেশই বোধহয় মানুষকে ভ্রমণপিপাসু করে তোলে।

যে পাহাড়ের কথা বললাম, সে গিরিরাজ হিমালয় আর তার শাখা পাহাড় সেবক। সেবক শিলিগুড়ি থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে মাত্র। আমার আগের লেখাতে আমার স্নেহধন্য ভাতৃদেবের সৌজন্যে ও ঐকান্তিক সাহায্যে শিলিগুড়ির কিছু ফুলের সাথে আপনাদের পরিচয় ঘটিয়েছি। আমরা যে ভাবে সভ্যতার পিছনে ছুটে চলেছি, আশঙ্কা করা যায় আগামী ১০-১৫ বছর পর, এই ফুল গুলির অনেক প্রজাতি আর নাও দেখতে পেতে পারি। রিস্ক না নিয়ে যত পারা যায় ছবি তুলে রেখেছি পরের প্রজন্মের জন্যে। তাই প্রথম আর্টিকেল-এ  লেখা কম, ছবি বেশি।

শিলিগুড়ি থেকে হিমালয় দর্শন

এবার আসি ভারত-আত্মা হিমালয়ের কথায়। হিমালয় কত শান্ত- কোমল- ধীর- স্থির- নির্মম- ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর সুন্দর। ঈশ্বরের মতো। তার রাজ্যে সেই একমাত্র পুরুষ। এক প্রাণবন্ত মনুষ্যত্বের- পৌরুষত্বের পূর্ণ প্রতিকৃতি।

হিমালয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ ও সুবিধাজনক ঠিকানা দেবভূমি গাড়োয়াল। উত্তরাখন্ড দেবভূমি গাড়োয়াল আর কুমায়ুন নিয়ে তৈরী। কুমায়ুনের বিশিষ্ট ভ্রমণ স্থানের মধ্যে নৈনিতাল, রানীক্ষেত, আলমোড়া, মুন্সিয়ারি প্রভৃতি বিখ্যাত।  এর সাথে অনেকেই কম-বেশি পরিচিত হয়তো। কিন্তু কুমায়ুন বড্ডো বেশি গোছানো। সভ্যতার ছায়া এখানে বেশি। তাই কুমায়ুন ভ্রমণ ব্যয়সাধ্যও বটে। সে তুলনায় গাড়োয়াল অনেক বেশি ছাড়ানো-ছেটানো, অনেক বেশি ওয়াইল্ড। আপনাদের সাথে আজ গাড়োয়ালের রাজ্যেই যাবো।

সেপ্টেম্বর, ২০০৬। পঞ্চকেদারের দুই কেদার মদমহেশ্বর ও তুঙ্গনাথ যাত্রা করবো পদব্রজে। মানে ট্রেক করে। তাই সুবিধাজনক বলে স্থির করা হল থাকবো ঊখীমঠ -এ। ঊখীমঠ,  মন্দাকিনী নদীর ধারের এক ছোট্ট গ্রাম। উচ্চতা ৪,৩০০ ফুট। রুদ্রপ্রয়াগ জেলার অন্তর্গত। রুদ্রপ্রয়াগ শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে। যার উল্টো দিকে গুপ্তকাশী  (ঊখীমঠের উত্তর-পশ্চিম কোন)। ঠিক পিছন থেকেই ডাক দেবে কেদারডোম শৃঙ্গ, কেদারনাথ দর্শনের জন্য। তাছাড়াও উঁকি মারে নীলকণ্ঠ, মেরু, সুমেরু, চৌখাম্বা, গঙ্গোত্রী-শ্রেণী। আপনার চোখ জুড়িয়ে দেবে মন্দাকিনীর ওপারের (গুপ্তকাশী সংলগ্ন) দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা।

দূন এক্সপ্রেস-এ যাত্রা করা আর ধৈর্যের  পরীক্ষা দেওয়া সমার্থক। সাকুল্যে ৮০টি স্টপেজ। আমি তার চাইতে উপাসনা বা কুম্ভ এক্সপ্রেস এ যাওয়াকেই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করি। ভাগ্য খারাপ। দূন-ই জুটলো শেষে। উল্লেখ্য, সব গুলি ট্রেনই ছাড়ে হাওড়া স্টেশন থেকে। আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য হাওড়া থেকে হরিদ্বার। এরপর হরিদ্বার থেকে বাসে ঊখীমঠ যাওয়া। দূন এক্সপ্রেস রাত ৮.৩০ এ ছাড়ে। ট্রেন-এ উঠে খাওয়া দাওয়া করে আপার বার্থে শুয়ে গাড়োয়াল রাজ্যের স্বপ্নতেই তলিয়ে গেলাম।

শোণিতপুরের শিব-ভক্ত রাজা দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাণাসুর। তার নাকি হাজার হাত। একমাত্র শিব তার উপাস্য। অন্য দেবতাদের সে বিশেষ পাত্তা দেয় না। বিশেষ করে ভগবান বিষ্ণুর সাথে তার সম্পর্ক বড়ো খারাপ। এহেন শিবভক্ত ক্ষমতার দম্ভে শেষে কিনা শিবকেই করে বসেন অপমান। কিন্তু শিব বরাবরই ভক্তের প্রতি বড়ো দয়ালু। অপমান হজম করে হেসে শুধু মনেমনে বলেন, “সময় মতো সব প্রাপ্য পেয়ে যাবে বাছাধন”।

বাণাসুরের একমাত্র কন্যা ঊষা। খুবই আদুরে। স্বপ্নে সে অনিরুদ্ধ নামক এক যুবককে দেখে, তার প্রেমে পাগল। স্বপ্নের ঘোরে একদিন সে অনিরুদ্ধকে চিৎকার করে সম্বোধন করে ওঠে “প্রাণনাথ” বলে। ঊষার বাল‍্য তথা ছায়াসঙ্গিনী চিত্রলেখা (যে কিনা একাধারে চিত্রকর ও জাদুকরী) শেষে স্বপ্নে দেখা সেই রাজপুরুষ “অনিরুদ্ধ”-র ছবি একে দেন ঊষাকে। অনিরুদ্ধ হলো কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন ও রুকমাবতীর পুত্র; অর্থাৎ কৃষ্ণের নাতি। প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। কৃষ্ণ-পৌত্র আর বাণাসুর-কন্যা। নারদ নারদ।

একটা ধাক্কা লাগলো। ঘুম ভেঙে দেখি ট্রেন থেমে গেছে। চোখ কচলে উঁকি মেরে দেখলাম ভোরের আলোয় গয়া স্টেশন। চলেছি ঘন্টা দুয়েক লেট-এ। গাত্রোত্থান করে লেবু-চা খেয়ে আবার শয়ন দিলাম। আজ সারাটা দিন ট্রেনেই কাটাতে হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে কাল ভোরে নামবো হরিদ্বার স্টেশনে। শুয়ে-বসে-অলস ভাবে সময় কাটতে লাগলো। সেপ্টেম্বর হলেও গরমের তীব্রতা যথেষ্ট। মুঘলসরাই যখন ঢুকলো, তখন বেলা ১২টা। গরমের জ্বালায় শরীরে শুধু এক ছটাক আবরণ রেখে স্টেশনে পাইপের জলে স্নান করে নিলাম। গামছা মেলে দিলাম ট্রেন এর জানালায়। তবে এ সুবিধা এয়ারকন্ডিশন কামরাতে হবে না। প্রায় ১টা নাগাদ এলো বারাণসী। দূন এক্সপ্রেস-এ প্যান্ট্রি-কার নেই। বারাণসী থেকেই ভেজ-থালি। সুখাদ্য বলা যাবে না। তবে পেট ভরলো কোনোরকমে। আবার বাঙ্কে শুয়ে হারিয়ে গেলাম দেবভূমিতে।

ঊষার এক গো। অনিরুদ্ধকে চাইই চাই। আবার সহায় ছায়াসঙ্গিনী চিত্রলেখা। জাদুবলে অনিরুদ্ধকে এনে দিলেন ঊষার কাছে। দেখা গেল, অনিরুদ্ধও সুন্দরী ঊষাকে পেয়ে আত্মহারা। বাণাসুর থেকে ঘটনা গোপন রাখতে অনিরুদ্ধ নারীর ছদ্মবেশে থেকে গেলেন শোণিতপুরে, প্রেমিকা ঊষার কাছে। কিন্তু বাদ সাধলো প্রকৃতি। অন্তঃসত্ত্বা ঊষা ও অনিরুদ্ধ ধরা পরে গেলেন বাণাসুরের কাছে। অনিরুদ্ধ হলেন অবরুদ্ধ। এদিকে এতদিন নাতি নিরুদ্দেশ, কৃষ্ণ বসে থাকবার পাত্র নন। তাঁর কাছে খবর এলো, তিনি সুদূর দ্বারকা থেকে সৈন্য সামন্ত নিয়ে শোণিতপুর চলে এলেন। একদিকে শিবশক্তিতে বলীয়ান বাণাসুর, অপরদিকে স্বয়ং কৃষ্ণ (বিষ্ণু)। শুরু হলো মহাসংগ্রাম।

ফৈজাবাদ এসে আবার স্বপ্নভঙ্গ হলো। ট্রেন আর নড়ে না। কতক্ষণ আর শুয়ে থাকা যায়। ঘন্টা খানেক পর আবার চলতে শুরু করলো ট্রেন। ছাতু – চিড়া – বোর্নভিটা – কলা একসাথে মেখে রাত্রের খাবার শেষ করলাম। আসলে আইডিয়া থাকলে লাখনৌ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত। তখন ইন্টারনেট এতটা সহজলভ্য হয় নি। আর চলাফেরার অভিজ্ঞতাতেও আমি নবীন। শুধু সঙ্গী ইচ্ছে। যখন লাখনৌ এলো, তখন রাত প্রায় ১০ টা, আমি আবার সজ্জা নিয়েছি। ট্রেন লেট হবেই হবে। শুধু চিন্তা কখন পৌছাবো হরিদ্বার।

হরিদ্বার

 

Previous Aamar Mukti Khonjaar Poth (আমার মুক্তি খোঁজার পথ)
Next An Opium-Threat to China