প্রথম পর্ব:
ভ্রামরী দেবীর সন্ধানে।
অনেকদিন ধরেই সবাই বলাবলি করছে রিসর্টে থাকবো, রিসর্টে থাকবো। উত্তম প্রস্তাব। নিজের বাড়ি তালা বন্ধ করে লোটাকম্বল নিয়ে রিসর্টে গিয়ে রাত্রিযাপন। কর্মসূত্রে বেশ কয়েক বছর শিলিগুড়িতে আছি, কিন্তু এখনও ডুয়ার্স ঠিক মতো ঘোরা সেভাবে হয়ে ওঠে নি। এবার ঠিকঠাক প্ল্যান বানিয়ে জম্পেশ করে ঘুরতে হবে। একটু পড়াশুনা করে গন্তব্য স্থানগুলোর একটা সার্কিট তৈরি করা হলো, আর থাকবার জন্য বুক করা হলো লাটাগুড়ির রূপসী বাংলা রিসোর্ট। ঠিক হলো সক্বাল সক্বাল বেড়িয়ে দুই-তিনটা জায়গায় ঢু মেরে উঠব রিসোর্টে। স্নান-খাওয়া করে আবার ভ্রমণ। পরিকল্পনা মত সুভাষদা গাড়ি নিয়ে হাজির।
শিকারপুর হয়ে ভ্রামরীদেবী মন্দির:
আমরা প্রথম গেলাম শিকারপুর। এখানে রয়েছে দেবীচৌধুরানী-ভবানী পাঠকের স্মৃতিবিজড়িত সন্ন্যাস-মন্দির। এ সম্পর্কে আলাদা করে লিখছি, তাই বিশদে গেলাম না। এ স্থানে বেশ কয়েক বার এসেছি, আরও আসবো। একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। শুধু এতটুকু বলি যে উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গার মত শিকারপুর চা বাগানের গভীরে ভবানী পাঠকের এই সন্ন্যাস মন্দির ইতিহাস, রহস্য ও জনশ্রুতির সংমিশ্রণ। জলপাইগুড়ি জেলার বেশ কয়েকটি জায়গা আছে যেগুলিতে দেবীচৌধুরানী ও ভবানী পাঠকের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে এর দূরত্ব ৩০-৩৫ কিলোমিটার। শিকারপুরের এই মন্দিরটিতে সাওডাঙ্গী বাইপাস রোড দিয়ে আমবাড়ি হয়ে যাওয়া যায় অথবা ফুলবাড়ি ক্যানেল রোড ধরে আমবাড়ি হয়ে যাওয়া যায়। শেষের ৭-৮ কিলোমিটার রাস্তা চা বাগানের ভিতর দিয়ে। বেশ উপভোগ্য যাত্রা। দুপাশে সমান করে ছাঁটা সবুজ চা বাগান। চোখ ও মনের আরাম। রাস্তা যদিও অপ্রশস্ত, কিন্তু পিচের পাকা মসৃণ রাস্তা। তাই গাড়ির জারকিংও কম। সময় লাগলো প্রায় এক ঘন্টা।
এরপর গন্তব্য বোদাগঞ্জের ভ্রামরীদেবী মন্দির। জলপাইগুড়ি জেলার বোদাগঞ্জে তিস্তা ও মহানন্দা ক্যানেলের সন্নিকটস্থ ত্রিস্রোতায় শালবাড়ি গ্রাম। শাল গাছের আধিক্য থাকায় সম্ভবত এই নাম। এখানেই ৫১ সতীপীঠের অন্যতম, ভ্রামরী দেবীর অবস্থান। ভবানী পাঠকের সন্ন্যাস-মন্দির থেকে ভ্রামরীদেবী মন্দিরের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। সময় লাগে ২০-২৫ মিনিট। রাস্তা সংকীর্ণ। চা-বাগানের ভিতর দিয়ে। ঘন শাল জঙ্গলের ভিতরে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে দাড়িয়ে রয়েছে মন্দির। বছর পনেরো-কুড়ি আগেও জায়গাটা বেশ নির্জন ছিল। মন্দিরের আজকের পরিবেশের সাথে কুড়ি বছর আগের মন্দির ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার চিত্র গুলিয়ে না ফেলাই ভালো। এখন লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মন্দির এখন পাকা এবং অনেকটাই এক্সটেন্ড করেছে। বসেছে ফ্লোর টাইলস। এখন মন্দির প্রবেশের দুই ধারে পূজার ডালা বিক্রয় কেন্দ্র গজিয়েছে গোটা বিশ-ত্রিশেক। উল্লেখ্য, ডালাগুলিতে প্লাস্টিকের জবা ফুলের মালা বিক্রয় হয়। মোটের উপর বলা যায় যে স্থানীয় অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। তবে আমরা যতবার পূজো দিতে এসেছি, পূজার উপকরণ শিলিগুড়ি থেকেই নিয়ে এসেছি, এবারেও তার অন্যথা হয় নি।
তখন সত্যযুগ। দক্ষ-কন্যা সতী, দক্ষযজ্ঞেই অনিমন্ত্রিত। রক্তের টান। তাই পতি-নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সতী উপস্থিত পিতৃগৃহে। কিন্তু পিতার বাক্যবাণ থেকে মুক্তি কোথায়। শেষে শিব-নিন্দা সহ্য করতে না পেরে, সতী আত্মাহুতিই শ্রেয় মনে করলেন। খবর পৌঁছালো যথাস্থানে। বিরহকাতর মহাদেব কালভৈরবকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে (কাল ভৈরব হলো শিবের অংশ বা দেহাংশজাত)। আর স্বয়ং শিব, সতীর দেহ নিয়ে শুরু করেন তাণ্ডব-নৃত্য । ফলে বিষ্ণুকে ফিল্ডে নামতে হলো। তিনি সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করতে শুরু করলেন। সেই খণ্ডিত দেহাংশগুলো ছড়িয়ে পড়লো ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশ সমূহে (ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থাৎ নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্থান প্রভৃতি দেশে)। এই অংশ গুলো যেখানে যেখানে পড়েছে, সেখানেই তৈরি হয়েছে মন্দির। এগুলোই সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ হিসাবে পরিচিত।
পীঠনির্ণয়তন্ত্র হিসাবে বোদাগঞ্জের ত্রিস্রোতায় সতীমার বা-পায়ের পাতা পড়েছে। মূল মন্দিরে প্রবেশের ঠিক বাইরে দুটি বটগাছ উপরে উঠে একত্রিত হয়েছে। সে কারণে এই অঞ্চল জোড়া-বটতলা নামেও খ্যাত। তাতে বেশ কয়েকটা মৌচাক আছে। মূল মন্দিরে রয়েছে দেবী ভ্রামরীর বিগ্রহ। তিনি সিংহের উপরে দাঁড়িয়ে, নিচে শায়িত দেবাদিদেব মহাদেব। একপাশে রয়েছে দেবীর ঘট ও অষ্টভুজা দেবীর সিংহারূঢ়া চণ্ডীমূর্তি। সাথে আছে মহাদেবের এক বিশাল মূর্তি। তিনি পদ্মাসীন। পূর্বমুখী পাশের প্রকোষ্ঠে সিড়ি দিয়ে নামলে দেখতে পাই সিঁদুর মাখানো সতীমার বাম পায়ের পাতা। কথিত আছে ১৩ রিং কুয়ো খুঁড়ে এই স্বপ্নাদিষ্ট চরণ পাওয়া গেছিলো। এই চরণ সব হিন্দুরাই শুধু স্পর্শ করতে পারেন। এ ছাড়া মন্দিরে মা লক্ষ্মী, শিবের সতীস্কন্ধে প্রলয় নৃত্য মূর্তি ও পুরাণের নানা কাহিনী আখ্যায়িত রয়েছে। বাইরে রয়েছে নাগদেবীর স্থান। এছাড়াও মন্দিরে রয়েছে পূরাণে বর্ণিত আখ্যানানুসারে তৈরী একাধিক মূর্তি। এই মূর্তিগুলি মূল মন্দিরে ঢোকার বাইরের প্রশস্ত অলিন্দে রাখা রয়েছে এবং এঁরা ভ্রামরী-মা ও মহাদেবের মতো নিত্য পূজা পেয়ে থাকেন। মাঘী পূর্ণিমার সময় গাছ তলায় কুমারী পূজো হয়। অলিন্দে বেশ কিছু চেয়ার রাখা রয়েছে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে। আমরা পূজো দিয়ে বাড়িতে তৈরি রুটি ও তরকারি সহযোগে ব্রেকফাস্ট ওখানে বসেই সারলাম।
ভ্রামরী নামের উৎস খুঁজতে গেলে, পুরাণের একটি আখ্যান এখানে উল্লেখ্য। অসুররাজ অরুনের প্রতাপে একদা দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গলোক থেকে হলেন বিতাড়িত। দেবতাদের তাড়িয়েই ক্ষান্ত হলেন না অসুররাজ; তার নজর পড়লো দেবপত্নীদের দিকে। অসহায় দেবপত্নীগণ স্মরণ নিলেন দেবী পরমেশ্বরীর। অসুরনিধনে দেবী পার্বতী তখন বিশালাকৃতি ভ্রমরের রূপ ধারণ করলেন। ভ্রমররূপ ধারণের জন্যই দেবী পরিচিতি পান ভ্রামরীদেবী রূপে। অবশেষে, তাঁর নেতৃত্বে বিশাল ভ্রমর বাহিনীর সাথে যুদ্ধ বাঁধে অরুনাসুর বাহিনীর। ভ্রমররূপী দেবী পারমেশ্বরী অরুনাসুরের বুক চিরে তাকে হত্যা করেন, দেবতারাও ফিরে পান হৃতরাজ্য। এখানের আরেকটি বিশেষত্ব হলো যে কোনো সময়ে এলে দেবীর পুজো দেয়া যায়।
মন্দির স্থাপনের কাল নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। রয়েছে বিতর্ক, কোনটি প্রকৃত সতীপীঠ, এই বোদাগঞ্জের ভ্রামরীদেবী মন্দির নাকি জল্পেশ্বর (জল্পেশ) মন্দিরের নিকটবর্তী ভ্রামরীদেবী মন্দির। শুনেছি উত্তরবঙ্গে পাঁচ-পাঁচটি ভ্রামরী মা’র মন্দির আছে। জনশ্রুতি, ব্রিটিশ আমলে ঘনজঙ্গল বেষ্টিত বোদাগঞ্জে আস্তানা গাড়েন একদল বিপ্লবী এবং তাঁরা স্থানীয় মানুষের সহায়তায় সশস্ত্র বিপ্লবের অনুশীলন কেন্দ্রও গড়ে তোলেন এখানে। ব্রিটিশ রাজের চোখে ধুলো দেবার জন্যই নাকি এই স্থান সতীপীঠ হিসাবে প্রচার। ধর্মের আড়ালে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের এক অনেস্ট অ্যাটেম্পট। ভ্রামরীদেবী বৃত্তান্তের আপাতত এখানেই ইতি। তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বোদাগঞ্জের ভ্রামরীদেবী মন্দির গ্ল্যামারের দিক দিয়ে অন্যান্য ভ্রামরীদেবী-মন্দির গুলির তুলনায় অনেকটই এগিয়ে।
পেটপূজো শেষ। গাড়িতে যে যার আসন গ্রহণ করলাম। সুভাষদাও রেডি। এবার গন্তব্য গজলডোবা, মূর্তি হয়ে রূপসী বাংলা রিসর্ট। সেটা পরের দিন।
ভালো থাকবেন।