এপ্রিল, ২০১৯। অফিসের এক সহযোদ্ধা কৈলাস-এর উৎসাহ ও আগ্রহে দুই পরিবার মিলে এসেছি তাগদা। রঙ্গোলি-রঙ্গোলিয়ট ব্লক-এ। দুই রাত আছি প্রধান হোম-স্টে তে (যোগাযোগের ঠিকানা – Pradhan’s Homestay – সরন প্রধান, তাকদা ক্যান্টনমেন্ট, পো. তকদা, ডিস্ট্রিক্ট. দার্জিলিং, পিন ৭৩৪২২২, ফোন নং. ৯৮৩২৫৫৯৮৪৯/৯৫৯৩৬৪০৫৭৭)। আজ যাবো মংপু। পর্যটন মানচিত্রে মংপু নূতন নয়, আবার ঠিক গ্ল্যামারাসও বলা যাবে না। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়াং – এদের উজ্জ্বলতার কাছে যেন অনেকটাই ম্লান। ছোট্ট মিষ্টি নদী রম্ভি (রম্বি) এখানে বয়ে চলেছে। শুনেছিলাম এই স্বচ্ছতোয়া রম্ভির (রম্বি) ঝর্নার জল খচ্চরের পিঠে করে সিঙ্কোনা ফ্যাক্টরিতে ব্যবহারের জন্য একসময়ে নিয়ে যাওয়া হতো।
সক্কাল সক্কাল তাগদা ক্যান্টনমেন্ট (রঙ্গোলি-রঙ্গোলিয়ট ব্লক) এর প্রধান সাহেবের হোম-স্টে থেকে বিদায় নিয়ে মংপুর পথে রওনা দিলাম। আমাদের বিদায় জানতে এসেছিলেন গ্রিফিথ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভীম প্রধান মহাশয় (২০১৯, শিক্ষারত্ন প্রাপক)। রওনা দিলাম ঋষি রোড ধরে। যথেষ্ট ভালো ও চওড়া রাস্তা। চড়াই উৎরাই আছে, প্রায় ৬৮০০ ফুট অবধি উঠে আবার নামতে হয়। মংপুর উচ্চতা ৩৭০০ ফুট। দূরত্ব প্রায় ৪০-৪৫ কিলোমিটার। রাস্তার দুই ধারে ঘন সবুজ প্রকৃতি। সবুজেরও কত বৈচিত্র্য। সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ছে। সময় লাগলো প্রায় দেড় ঘণ্টা। মংপুর প্রধান আকর্ষণ রবীন্দ্র ভবন, অর্কিড হাউস, সিঙ্কোনা ফ্যাক্টরি আর রাস্তার চারধারে অসংখ্য সিঙ্কোনা ও এলাচ গাছ।
মংপু-তে কন্যা
প্রথমে গেলাম মংপু অর্কিড হাউস-এ। মূল শহর থেকে বাইরে বেশ কিছুটা উপরে। এন্ট্রি-ফি জন-প্রতি ২৫/-। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি। রয়েছে বেশ কিছু জায়েন্ট সাইজের অর্কিড, টিউলিপ, স্টবেরি প্রভৃতি। অর্কিড গুলির রঙ-বৈচিত্রও দেখবার মতো । অর্কিডের ছবি তোলাতে এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে, অর্কিডগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করতে পারি নি। স্ট্রবেরি ফুলও খুব সুন্দর। টিউলিপ ফুলের বেশ কয়েকটি কালার ভারিয়েশন এখানে আছে, কিন্তু আর কয়েক দিন পর এলে বোধহয় ফুটন্ত দেখতে পেতাম। চাইলে শুধুমাত্র একটা দিনই অর্কিড হাউস-এ দেওয়া যায়। তবে এখানেও সরকারি আনুকূল্যের অভাব স্পষ্ট। তাই বিশাল পরিসরের মাত্র কিছুটা অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সেগুলিও বেশ অগোছালো। দুটি দৃশ্য-কেন্দ্র আছে; সেগুলি থেকে প্রায় ২৭০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। মেঘমুক্ত আকাশে, ভিউ পয়েন্ট দুটি থেকে কাঞ্চনজঙ্গা স্পষ্ট দৃশ্যমান। এছাড়া সেলফু, লেপচু, সিটং, লাতপাঞ্চের, তাগদা প্রভৃতি জায়গা বেশ স্পষ্ট দেখা যায়।
মহঃ ফজলুল করিম সাহেবের (গভ. সিঙ্কোনা ফ্যাক্টরির চিফ কেমিস্ট, মংপু হাই স্কুলের বিশিষ্ট শিক্ষক অরূপ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে ওনার সাথে পরিচয়) অতিথি পরায়ণতা মনে রাখবার মতো। তার বাংলোতে যখন সপার্ষদ-সপরিবারে হাজির হলাম, তখন তিনি অপিসে। ফোন পেয়ে কাজ ফেলে চলে এলেন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজনের তদারকি করলেন। পঞ্চব্যঞ্জন আর মৎস্য সহযোগে খাওয়া বেশ ভালোই হলো। করিম সাহেব নিজে হাতে রসগোল্লা পরিবেশন করলেন। এরপর করিম সাহেবের সাথে সংক্ষিপ্ত আড্ডা। সময় বড় কম। আজই শিলিগুড়ি নামতে হবে। তাই বেরিয়ে পড়লাম। ওনার বাংলো থেকে গভ. সিঙ্কোনা ফ্যাক্টরি, রবীন্দ্র ভবনের আগে পরে । যদিও উনি ফ্যাক্টরি ইন-চার্জ মদন মুখিয়াকে বলে রেখেছিলেন, কিন্তু হাতে সময় কম থাকায় সিঙ্কোনা ফ্যাক্টরিতে ঢোকা আর হয়ে উঠলো না। আমরা রওনা দিলাম রবীন্দ্র ভবনের উদ্দেশে।
নির্জনতায় ঘেরা সাদা রঙের রবীন্দ্র ভবন মূল মংপু শহর থেকে কিছুটা নিচে। সাদা রঙের বাংলো প্যাটার্নের তৈরী রবীন্দ্র ভবন সত্যিই নস্টালজিক করে তোলে । বন্ধুকন্যা মৈত্রেয়ী দেবীর ডাকে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে চার বার মংপু ঘুরে গেছেন। তখন মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মনমোহন সেন সিঙ্কোনা ফ্যাক্টরির ম্যানেজার রূপে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৪২-এ কবির সাথে তাঁর আলাপচারিতা ও কবির মংপুর জীবনযাপনের উপর স্মৃতিকথা স্বরূপ মৈত্রেয়ী দেবী “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ” লেখেন। উল্লেখ্য কবি এখানে একবার তাঁর জন্মদিন কাটান এবং তাঁর বিখ্যাত “জন্মদিন” কবিতা এখানেই লেখা। পরবর্তীতে কবির নিজকণ্ঠে আবৃত্তি করা এই কবিতাটি ‘All India Radio’ থেকে প্রচারিত হয়। রবীন্দ্র ভবনে রয়েছে কবির স্মৃতিধন্য বেশ কিছু সাদাকালো দুষ্প্রাপ্য ছবি। রয়েছে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নক্সা করা কবির ব্যাবহারের জন্য বিশেষ খাট, চেয়ার, টেবিল, স্নানঘর, ফায়ার প্লেস । এছাড়াও রয়েছে কবির ব্যবহৃত দোয়াত কলম, রং, দুষ্প্রাপ্য কিছু নথিপত্র প্রভৃতি। কেয়ার্টেকার শিশির রাউত আপন প্রচেষ্টায় অক্লান্তভাবে এর দেখভাল করছেন। সঙ্গী স্থানীয় যুবক কুশল মুখিয়া। করিম সাহেব ও মুখিয়া ভাই এর থেকে শিশির বাবুর রবীন্দ্রসংগীত ও কবিতা আবৃত্তির গুনগান শুনেছি। ভাগ্য খারাপ, তাই শিশির বাবুর সাথে দেখা হলো না। কুশল মুখিয়ার থেকে রবীন্দ্র ভবনের মেইনটেন্যান্স এর ব্যাপারে সরকারি অপ্রতুলতার কথা শুনলাম। সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পের ফলে বেশ কিছু কাঁচের জানলা ভাঙ্গা ও কিছু জায়গায় চিড় ও ধরেছে। দেখে শুনে খারাপ লাগলো। কিন্তু সীমিত ক্ষমতা আমাদের।
ফেরার রাস্তা রম্ভি বাজার, কালিঝোরা, সেবক হয়ে শিলিগুড়ি – প্রায় ৫০ কিলোমিটার। রম্ভি বাজারে রম্ভি (রম্বি) নদী এসে মিশেছে তিস্তার সাথে। রম্ভি থেকে সেবক পর্যন্ত এবার আপনার সঙ্গী তিস্তা। কালিঝোরা বাঁধের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পরে, কালিঝোরা বাঁধের পর থেকে সেবক অবধি যে তিস্তা আপনারা আজ দেখছেন, তার সাথে ২০ বছর আগের তিস্তাকে গুলিয়ে না ফেলাই ভালো। জানিনা সত্যিই প্রকৃতিকে বেঁধে রাখা যায় কিনা। সময়ই এর উত্তর দেবে। গাড়ি শিলিগুড়ি ঢুকছে। কাল থেকে একঘেয়ে অফিস। আবার জ্যাম, আবার পলিউশন। আজ এইটুকুই থাক। আবার দিন কয়েকের জন্য নয় পাহাড়ের বাঁকেই হারিয়ে যাওয়া যাবে ।
(রবীন্দ্রভবনের চিত্রটি মোনালিসা ভট্টাচার্য্যর সৌজন্যে প্রাপ্ত)
Thanks for time.
MUNGPOO…