এলার্মের শব্দে এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে উঠে দৈনন্দিন রুটিন অনুযায়ী যন্ত্রের মত কাজ শুরু করলাম। ছেলের আজ বাংলা পরীক্ষা। ক্লাস ফাইভে উঠবে। আজই তার শেষ পরীক্ষা। অত রাত্রি অবধি পড়িয়েও মনে শান্তি নেই। সব লিখে আসতে পারবে কিনা কে জানে? মাতৃভাষা বলে সারা বছর জোরটা কমই দেওয়া হয়। ছেলের শান্ত নিশ্চিন্ত ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে এইসব ভেবে যাচ্ছি। ঘুমন্ত ছেলেকে জাগাতে কষ্ট হলেও উপায় নেই, ঘড়ির কাঁটা তো আর থেমে নেই। সে নিজের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
যাই হোক টিফিন করতে করতে ছেলেকে টেনে তুলে রেডি করাচ্ছি। আর তার সাথে সাথে কাল রাত্রে যে পড়া গুলো পারে নি সেগুলো মন্ত্রের মতো কানের কাছে জপ করছি। এদিকে তার বাবাকেও ঠেলে তুলতে হলো ঘড়ির কাঁটা দেখে। তার তো ছেলের পরীক্ষা থাকলেও কোনো বিকার নেই।
ঠিক সময়ে বাপ-বেটা বেরিয়ে গেল। আমি যে কতবার উপরওয়ালাকে স্মরণ করলাম তা হাতে গুনে শেষ হবে না। যাই হোক তাড়াহুড়ো করে রান্না-বান্না শেষ করে আবার সাড়ে এগারোটায় বেরোতে হবে ছেলেকে আনতে। বারোটায় ছুটি তার। আজ পরীক্ষা শেষ বলে তার বায়নার অন্ত থাকবে না। তাই ফিরতে যে দেরি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আমি তো বারোটার মোটামুটি এক ঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেছিলাম স্কুলের গেটের সামনে। কারোর কোনো কথা শুনতে ভালো লাগছিলো না। উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি প্রশ্নপত্র দেখার জন্য। হঠাৎ ছেলের হাসিমাখা মুখ দেখে আশা করলাম পরীক্ষা তাহলে বোধহয় ভালোই হয়েছে। ছেলেকে হাতে পেয়ে আর কোনো কথা না বলে ব্যাগ থেকে প্রশ্নপত্র-টা বের করে, তাতে চোখ বোলালাম। একটু নিশ্চিন্ত হলাম যে সবই জানার মধ্যেই এসেছে। ছেলে তো পরীক্ষা শেষ হওয়ার আনন্দে আত্মহারা। তার বায়না মত আইসক্রিম খাইয়ে বাড়িতে নিয়ে এলাম। তারপর তার জুতো খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করলাম “সব তো জানার মধ্যেই এসেছে, সব লিখেছো তো?” ছেলে বল খেলতে খেলতে বললো যে সে সব লেখে নি। আমি তো হতবাক ! বললাম “ভুলে গেছিলিস?” সে নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিলো যে তার সব মনে ছিল কিন্তু লেখে নি।
আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। বললাম “কেন?”
সে বললো ,” আমি হাত কে কত বার বললাম – হাত লেখ ! কত বুঝিয়েও বললাম লিখতে, কিন্তু হাত শুনলোই না আমার কথা। তাই শেষ দুটো প্রশ্নের উত্তর আমি লিখি নি।”
আমি তখন ছেলেকে বকবো, না মারবো, না তার বাবাকে ফোন করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। হতবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছি। তখন ছেলে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,”মা আমাকে মেরো না। আমি সত্যি হাতকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, তোমার ভয়ও দেখিয়ে ছিলাম। কিন্তু সে আমার কথা শোনে নি।” তারপর কতক্ষন যে নিশ্চুপ বসেছিলাম খেয়াল নেইl তার বাবার ফোনের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরলো।
ফোন ধরে আমি নিশ্চুপ। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বেরোচ্ছে না। ওই প্রান্তের “হ্যালো-হ্যালো” শব্দ কানের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছে। তবু আমি কোনো কথাই বলতে পারছি না। কিন্তু জানি ওর খুব টেনশন হবে, তাই ওকে একবার বাড়ি আসতে বললাম। ও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করলো “কি হয়েছে”, কিন্তু তখন আমি বলার মতো শক্তি পাচ্ছিলাম না। তাই ফোন কেটে দিলাম। কোনো রকমে নিজের শরীরটাকে ঠেলে দাঁড় করালাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটো বেজে গেছে। তাই যন্ত্রের মতো ছেলেকে স্নান করিয়ে ভাতের থালা নিয়ে বসে তাকে খাইয়ে দিলাম। আমার খাওয়ার ইচ্ছে একেবারেই নেই। হাত ধুতে ধুতে কলিং বেলের আওয়াজ পেলাম। আমি আসার আগেই ছেলে দরজা খুলে দিয়েছে। ওর বাবা হন্তদন্ত হয়ে আমার সামনে এসে বললো,” কি হয়েছে বলবে তো? এমন চুপ করে থাকলে আমি কি করে বুঝবো?” আমি কোথা থেকে শুরু করবো তাই ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেলাম ছেলে তার বাবাকে বলছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলাম ছেলের পিঠে ধমাধম দু ঘা পড়ে গেলো। আমি তাড়াতাড়ি ছেলেকে ওর বাবার হাত থেকে ছাড়াই। ছেলে তখন ভয়ে আমাকে শক্ত করে ধরে তারস্বরে কাঁদতে শুরু করেছে। আমি তো হতবাক ওর বাবার কান্ড দেখে। ওর বাবা কখনও ওর গায়ে হাত দেয় না। আমিই বরং দুস্টুমি করলে দু ঘা বসিয়ে দেই। ওর বাবার রাগ বেশি আমি জানি। তাই ছেলেকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে একেবারে শোয়ার ঘরে নিয়ে ঘুম পারিয়ে দিলাম।
ওর বাবার রাগ দেখে নিজের কষ্ট মনে চেপে তাকেই বরং বোঝালাম যে এইভাবে মেরে কিছু হবে না। “এর আগেও তো মার খেয়েছে। কিছু হয়েছে?” বললাম – “আমাদেরই কোথাও ভুল হচ্ছে বোধহয়।“
এই শুনে ওর বাবার রাগ আরো চড়ে গেলো, বললো “এগুলো সব তোমার ছেলের বদমাইসি। জানলে, লিখে আসবে না কেন? এই ভাবে চললে তোমার ছেলের অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে।”
আমি আর একটা ধাক্কা খেলাম। বদমাইশ হলে সন্তান বুঝি মায়ের হয়ে যায়? ভালো হলে কার হয়? রাগ হলো কিন্তু কিছু বললাম না। তখন আমার আর কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না, আবার তর্ক করবো? কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
আমার খাওয়ার একটুও ইচ্ছা ছিলো না কিন্তু ওর বাবার জোরাজুরিতে একটু খেতে হলো। আমার খাওয়া হলে ও আবার অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আমি দরজা বন্ধ করে সোজা শোয়ার ঘরে এসে ছেলের পাশে বসলাম। ছেলের কান্না ভেজা ঘুমন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত মায়াজালে আবদ্ধ হলাম। বুকের মধ্যে একটা চাপ অনুভব করলাম। নিজের মনেই প্রতিজ্ঞা করলাম ছেলের গায়ে আর আমরা কেউ হাত দেবো না। এই মন খারাপের রেশ যে রেজাল্ট বেরোনোর দিন অবধি চলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবার পূজো দেরিতে বোলে দু সপ্তাহ পর রেজাল্ট বেরোবে। তারপর পূজোর ছুটি শুরু হবে। মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত। ছেলে আমার প্রতিবার প্রথম চার/পাঁচ জনের মধ্যে থাকে। এবার যে কত নীচে নেমে যাবে কে জানে? এই সব নানা ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে পাঁচটা বাজে।
বিকেল হয়ে গেছে দেখে ছেলেকে আদর করে ঘুম থেকে তুললাম। সে তো চোখ খুলে আমাকে দেখেই এক লাফে উঠে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে শুরু করলো। আমিও জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে ঠান্ডা মাথায় ওকে জিজ্ঞাসা করলাম বাকি প্রশ্ন গুলো সব ঠিক ঠিক লিখেছে কিনা? যে চোখের জল মুছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কিন্তু তবু মনে শান্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে বুকের ভিতর একটা পাথর কেউ চাপা দিয়ে দিয়েছে। বড্ড ভার সেই পাথরের। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে ভেবেছিলাম বাকি পূজো শপিংটা পরীক্ষার পর মজা করে করবো। কিন্তু এখন আর কোনো কিছুই আর ভালো লাগছে না। এই ভাবে চোদ্দ দিন কাটাতে হবে আর তারপরের দিন রেজাল্ট। মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করলাম আমাদের ছোটবেলাকার কথা। আমাদের বাবা-মায়েরাও কি এত টেনশন করতেন? কিচ্ছু মনে পড়ছে না। তাহলে কি আমিই বেশি বাড়াবাড়ি করছি? জানি না। আমরাতো চার ভাই-বোন ছিলাম। আমাদের বাবা-মায়েরা কি করে পেরেছেন আমাদের পড়াশুনো করাতে? আর আমি একটা ছেলেকে পারছি না কেন? পাশের বাড়ির শাঁখের আওয়াজে বুঝলাম সন্ধ্যে হয়ে গেছে, সন্ধ্যে দিতে হবে। ও একটু পরেই অফিস থেকে চলে আসবে।
ছেলের করুন মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিয়ে অশান্ত মনে একটা একটা করে দিন কাটাতে শুরু করলাম। সঠিক দিনে আমরা তিনজনে রেজাল্ট নিতে স্কুলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ছেলে আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে। আমার মন খুব অশান্ত। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর চেনা পরিচিতদের দিকে চোখে চোখ পড়লে কষ্ট করে ইলাস্টিক হাসি হাসছি। কারোর সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না। ও মাঝে মধ্যে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে আমাকে সম্বিৎ ফেরাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যথা সময়ে ক্লাস-টিচার আমাদের ক্লাস রুমে ডেকে পাঠালেন। আমরা তিনজনেই গুটি গুটি পায়ে ভয়ে ভয়ে ম্যামের সামনের চেয়ারে বসলাম। ম্যামের মুখ হাসি হাসি দেখে আমি তো অনেক কষ্ট করে মুখে হাসির ছোঁয়া আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কাজ কতটুকু হলো বা আদৌ হলো কিনা জানি না। ম্যাম ছেলের রিপোর্ট কার্ড বের করে আমাদের সামনে এগিয়ে দিলেন এবং ছেলেকে কাছে ডেকে কংগ্রাচুলেশন জানালেন। আমি আর ও দুজনে দুজনের দিকে তাকালাম। ওকে দেখলাম রিপোর্ট কার্ড খুলে দেখতে শুরু করেছে। আমি তো ভয়ে ওই দিকে তাকাতেও পারছি না। ম্যামের দিকে স্ফীত নয়নে চেয়ে আছি।
ও মা হঠাৎ দেখি ম্যাম আমার ছেলে ‘সাগ্নিক রায়’ কে আশীর্বাদ করে ওর প্রশংসা করছেন। আমি তো হতবাক! ম্যাম কি বলছেন এসব? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না যে তিনটে বিষয়ে আমার ছেলে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছে ! তার মধ্যে একটি বিষয় হলো বাংলা। এতক্ষণে আমার মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোলো – “এটা কি করে সম্ভব? ও তো শেষ দুটো প্রশ্ন লেখেই নি”। ম্যাম এই কথা শুনে হেসে বললেন, “তাতে কি হয়েছে? বাকি উত্তর গুলো যে একদম ঠিক ঠিক লিখেছে। এমনকি একটা বানানও ভুল হয় নি। আমরা মার্ক্স্ কাটাবো কি করে?”
এই কথা শুনে আমি তখন চোখে বাঁধ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আর ওর হাত থেকে রিপোর্ট কার্ড টা ছিনিয়ে নিয়ে দেখছি যে এই অসম্ভব ও কি করে সম্ভব করলো। মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে আসছিলো লেখা গুলো। সত্যি সত্যি বাংলা, অঙ্ক আর বিজ্ঞানে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছে। আমি আমার নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চোখ বড় বড় করে দেখছি। যা দেখছি তা সত্যি। এতে কোনো ভুল নেই। ম্যাম তো খুব খুশি। আমার ছেলে ‘সাগ্নিক রায়’ সব সাবজেক্ট মিলিয়ে সেকশনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। আর পুরো ক্লাসের পাঁচটা সেকশন মিলিয়ে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে । আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না, তাই এক হাতে রিপোর্ট কার্ডটা নিয়ে, আর এক হাতে আমার ছেলেকে ধরে, সবার সাথে শেষ বাক্য বিনিময় করে, প্রস্থানে উদ্যত হলাম। এই সময় আমার মনের একটা কোণে যে একটু অহংবোধের উদয় হয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সটান স্কুলের বাইরে এসে, ছেলের প্রিয় আইসক্রিম কিনে, ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলাম। তারপর বাড়িতে ফিরে, দরজা খুলে ঘরে ঢুকেই সোফায় এলিয়ে পড়লাম।
মনে হলো এই কয়দিন যেন একটা বড় পাথরের ভার বইতে বইতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ছেলের তো নয়, যেন আমার পরীক্ষা ছিল। ছেলে দিব্যি জুতো খুলে সটান আমার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,”মা আমাকে এবার আদর করো” আমি আর আমার চোখের জলের বাঁধ আটকাতে পারলাম না। আহা রে নিরীহ ছেলেটা আমার।
এবার দেখলাম ওর বাবা পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করে ছেলেকে কোলে নিয়ে মাথায় চুমু খেলো। অনেক চেষ্টা করলাম বুকের ভিতর যে পাথরের ভারটা ছিল সেটা আবার অনুভব করার, কিন্তু পারলাম না। তবে এটা অনুভব করলাম যে আজ একটা লম্বা ঘুম আমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইছে।
অন্তত এবারের মতো হেরে যেতে হলো না তাহলে !
Featured image courtesy: pxhere.com, pixabay.com and needpix.com (Modified)